কল্পবিশ্বের নাগরিক
কল্পবিশ্বের নাগরিক
শীতের সন্ধ্যায় কলেজ স্ট্রিটের প্রায় বন্ধ দোকানগুলোর সামনে দ্রুত ঘুরে বই খুঁজছিলাম । কলকাতার বাইরে থাকার জন্য ওখানে যাবার সুযোগ খুবই কমে গেছে, তাই যে কটা দিন পাওয়া যায় ঘুরে আসি । কিন্তু সেদিন একটু দেরি হয়ে যাওয়ায় চেনা দোকান গুলো বন্ধ হয়ে গেছিল । একটি অপরিচিত দোকানে জিজ্ঞেস করি, “দাদা, কল্পবিজ্ঞানের নতুন কী বেরিয়েছে”? ভদ্রলোক একবার আমার দিকে তাকিয়ে গম্ভীর গলায় বললেন,“একটু মূল ধারার সাহিত্য পড়া অভ্যেস করুন”। প্রশ্নটা ভুল জায়গায় করা হয়ে গেছে,- দোকানের সামনে সাজানো অপরিচিত ম্যাগাজিন গুলো দেখে আমার আগেই বোঝা উচিত ছিল । তবে জীবনে ৪৪ খানা উপন্যাস আর শতাধিক গল্প, ব্রিটিশ সায়েন্স ফিকশন এসোসিয়েশনের পুরস্কার, এ ছাড়া নেবুলা, হুগো সহ তাঁর সময়ে কল্পবিজ্ঞান সাহিত্যের প্রায় সমস্ত পুরস্কার/মনোনয়ন পাওয়া লোকটিকেও একই ধরনের কথা শুনতে হয়েছিল ।
ফিলিপ কে ডিকের লেখার মতো তার নিজের জীবনও কোন কল্পকাহিনীর থেকে কম নয় । এই আমেরিকান কল্পবিজ্ঞান লেখকের জীবনের শুরুতেই কবর খোঁড়া হয়ে গেছিল। জন্মের ছয় সপ্তাহের মধ্যেই তাঁর জমজ বোনের মৃত্যু হয় ; বোনের মৃত্যুর প্রায় ৫৩ বছর পরের তাঁর মৃত্যু হলেও কবরে তাঁর নামটা বোনের মৃত্যুর সময়েই লেখা হয়ে গিয়েছিল এবং মৃত্যুর পরে যমজ বোনের কবরের পাশেই ওঁকে সমাহিত করা হয়।
ওঁরা ক্যালিফোর্ণিয়ায় বে এরিয়াতে চলে এসেছিলেন এক সময়ে। ডিক ক্যালিফোর্নিয়ার বার্কলেতে বার্কলে হাই স্কুলে পড়াশোনা করেছেন। তিনি এবং উরসুলা লে গুইন একই স্কুলের স্নাতক শ্রেণির (1947) সদস্য ছিলেন, তবুও ওঁরা সেই সময়ে কেউ কাউকে চিনতেন না।
তাঁর প্রথম লেখা যখন প্রকাশিত হয়, নিজেই নিজের লেখা কিনতে গিয়ে তিনি জনৈকা পাঠিকার প্রশ্নের সম্মুখীন হন । তাঁদের কথোপকথন অনেকটা এইরকম ছিল :
পাঠিকা: আপনি কি ঐ ধরনের লেখা পড়েন ?
ডিক : ম্যাডাম, আমি শুধুমাত্র এটা পড়িনা , আমি এটা লিখি।
পাঠিকা: আপনি কল্পবিজ্ঞান কেন লেখেন ? গম্ভীর কোন বিষয় নিয়ে কেন কিছু লেখেন না ?
তবে এই ধরনের প্রশ্নে নতুন লেখক একেবারেই বিচলিত হননি। তাঁর মতে তিনি সবচেয়ে গভীর কল্পনাপ্রসূত উপন্যাসটি লেখার চেষ্টা করে গেছেন এবং সেটা বিশ্বের মধ্যে ছড়িয়ে দিয়েছেন একটাই আশায় যে, কোন এক সময়ে হয়তো তাঁর কাহিনী পাঠক/পাঠিকা পাবে৷ তাঁর সে আশা সম্পূর্ণ ভাবে বাস্তবায়িত হয়েছে । পাঠকেরা তাঁকে এখনো ভুলতে পারেননি , তাঁর মৃত্যুর প্রায় ৪০ বছর পরে এখনও নিয়মিত ভাবে তাঁর নামে উৎসব পালন করে চলেছেন গুণমুগ্ধরা। হলিউড-প্রেমীরাও তাঁর কাহিনী অবলম্বনে তৈরী প্রতিটি সিনেমাকে (যেমন Blade Runner, Total Recall, Minority Report, Paycheck ইত্যাদি) সাদরে গ্রহণ করেছেন।
ডিকের লেখা প্রায়ই বাস্তবতার বিষয়গত প্রকৃতি অন্বেষণ করে বস্তুনিষ্ঠ সত্যের ধারণাকে চ্যালেঞ্জ করে| ওঁর কাজগুলো বাস্তবতা এবং বিভ্রমের মধ্যে সীমানাকে অস্পষ্ট করে, পাঠকদের মনে তাদের নিজস্ব উপলব্ধি নিয়ে প্রশ্ন তোলে। উনি মনে করতেন করতেন আমরা একটি কম্পিউটার-প্রোগ্রাম করা বাস্তবতায় বাস করছি, - আমাদের কাছে এটির একমাত্র সূত্রটি হল যখন কিছু পরিবর্তনশীল রাশির পরিবর্তন করা হয় এবং আমাদের বাস্তবতায় কিছু পরিবর্তন ঘটে। এই পরিবর্তনগুলো ঠিক déjà vu-এর মতোই মনে হয়, এই ধরনের পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে শাখা বিভাজিত হয়ে বিকল্প বিশ্বের সৃষ্টি হয় । এই ধারণাটা একটু কঠিন মনে হলেও Matrix সিনেমায় ব্যাপারটা সহজ ও বোধগম্য ধরা হয়েছে । অনেকেই বিশ্বাস করেন ডিক Matrix এর স্বপ্নটা বহু আগেই দেখে ফেলেছিলেন ।
লিওনার্দোর নোটবুকের কথা সকলেরই জানা , বহু যুগান্তকারী আবিষ্কারের সম্ভাবনার কথা এবং সম্ভাব্য নকশা বহু যুগ আগেই উনি নিজের নোটবুকে লিখে গেছেন । ডিকের হ্যান্ডনোট, খসড়ার কাগজ আর অপ্রকাশিত প্রবন্ধের মাঝেও অজানা কিছুর সন্ধান পাওয়া যায় । ‘এক্সিজেসিস’ এইসব আড়ালে থাকা লেখাগুলো জুড়ে গড়ে তোলা একটি মরণোত্তর সঙ্কলন । সুবিশাল এই সংগ্রহে তাঁর মনের আভ্যন্তরীন জগতের সঙ্গে পরিচিত হবার রসদ আছে । অনুভূতির বাস্তব , কল্প বাস্তব আর বিকল্প বাস্তবতা নিয়ে তাঁর দার্শনিক অনুসন্ধান এবং আধ্যাত্মিক চিন্তার এক অনন্য আভাস পাওয়া যায় এই ‘এক্সিজেসিস’- এ । এই লেখাগুলির কিছু আমরা এই সময়ে বসে বুঝতে পারি , আর বাকিটা হয়তো ভবিষ্যতে বোঝা যাবে বা যাবে না । দৰ্শনের গোলকধাঁধায় হারিয়ে যাওয়া সম্ভব কিন্তু গন্তব্যে পৌঁছনো হয়তো কখনোই সম্ভব হবে না। তবে তাঁর কল্প-কাহিনীর মাঝের অধিভৌতিক উদ্বেগগুলো অনেক ক্ষেত্রেই বাস্তব হয়েছে বা হতে চলেছে । এর মধ্যে কয়েকটি সম্ভাবনা নিয়ে একটু আলোচনা করবো।
এক্সিজেসিস বইতে ফিলিপের আঁকা এলিয়েন মানুষের ছবি
এই ছবিটায় হিন্দু বা বৌদ্ধ ধর্ম জ্ঞানচক্ষু অবলম্বনে হয়তো উনি তৃতীয় চক্ষুটি কল্পনা করেছিলেন। উচ্চতর বুদ্ধিমত্তার এই সব এলিয়েন প্রাণীরা স্যাটেলাইট চালিত তথ্য-রশ্মির মাধ্যমে তাঁর সাথে যোগাযোগ করেছিল, সেটা তিনি বিশ্বাস করতেন। ১৯৭৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে তার আক্কেল দাঁতের একটা অপারেশন করা হয়। অপারেশনের সময়ে ব্যথা কমানোর জন্য তাঁকে sodium pentothal দেয়া হয়। অনুমান করা হয় এই পেইন কিলারের প্রভাব তাঁর চিন্তাধারাকে আংশিক ভাবে প্রভাবিত করেছিল । তাঁর নিজের অভিজ্ঞতা অনুসারে উনি সেই সময়ের একটি ঘটনা বর্ণনা করে গেছেন। ফেব্রুয়ারির এক সন্ধ্যায় ডোরবেলে সাড়া দিতে গিয়ে ফিলিপ কালো চুল এবং বড় চোখ চোখের মালকিন এক সুন্দরী মহিলার সাথে পরিচিত হন, যিনি একটি ওষুধের প্যাকেট দিতে এসেছিলেন। ডিক ওই মহিলার গলার সোনালী লকেটের প্রতি আকর্ষিত হন। তাঁর মতে সেখান থেকেই তাঁর অতীত-দর্শনের সূত্রপাত। ডিকের প্রশ্নের উত্তরে ওই মহিলা ডিককে জানান, মাছের চিহ্ন প্রাচীনকালে খ্রিস্টানদের দ্বারা ব্যবহৃত হতো, এবং এটা সকলের নজরে পড়েনা। ডিকের বিশ্বাস, এই সোনালী মাছের চিহ্নটা তাঁকে খুব প্রাচীন স্মৃতি মনে পড়াতে সাহায্য করে। অতি প্রাচীন এই সব স্মৃতি হয়তো ডিএনএ-তে সংরক্ষিত থাকে। ডিএনএ থেকে স্মৃতি পড়ার প্রযুক্তি এখনও আবিষ্কৃত না হলেও বিশেষ কোন ঘটনা বা পরিস্থিতির সম্মুখীন হলে এই ধরনের স্মৃতি ফিরে পাওয়া সম্ভব বলে ডিক মনে করতেন। অন্তত উনি নিজের জীবনে তা পেয়েছিলেন বলেই তাঁর ধারণা।
মানসিক অসুস্থতা এবং ধর্মীয় অভিজ্ঞতার পার্থক্য অনেক ক্ষেত্রেই হারিয়ে গেছিল তাঁর জীবনে । তিনি নিজেই স্বপ্ন, বাস্তব আর তাঁর মনের মাধুরী মিশিয়ে সৃষ্ট কল্পনা ও বাস্তবের মধ্যে পার্থক্য করতে অসমর্থ হয়েছিলেন বহু ক্ষেত্রে । অবশ্য অনেকের মতে এর পেছনে ওনার বিভিন্ন ধরনের নেশা ও ড্রাগের ব্যবহার দায়ী। ৭৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে কথিত ডেন্টাল সার্জারি থেকে সুস্থ হয়ে ওঠার পরে তিনি অদ্ভুত কিছু গোলাপি রশ্মি দেখতে পান। তারপরে কিছু বিমূর্ত চিত্র এবং অপরিচিত ইঞ্জিনিয়ারিং যন্ত্রাংশের নীল নকশার দর্শন পেয়েছিলেন। আরও কিছু জোরালো আলোর দৃশ্য দেখেছিলেন যাকে তিনি তরল আগুন বলেছেন। তাঁর আশেপাশে বিভিন্ন ক্ষেত্রে পরিচিত দৃশ্যগুলি যেন রোমান সভ্যতার অংশবিশেষে পরিবর্তিত হয়ে যায়। তাঁর বাড়ির কাছে একটি ডে কেয়ার সেন্টারকে তাঁর একটি রোমান কারাগার বলে মনে হয়েছিল এবং সেখানকার শিশুদের মনে হয়েছিল সিংহকে খাওয়ানোর জন্য বন্দী করে রাখা খ্রিস্টান শহীদ । অনেক সময়ে তাঁর বাড়ির পাশের রাস্তার ফুটপাতে পথচারীদের তিনি রোমান সৈনিকের ইউনিফর্ম পরে হাঁটতে দেখেন। এসব অভিজ্ঞতাই তাঁর রোমান্টিক মানসিকতাকে সমর্থন করে। আরও অনেক খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীর মতোই তিনিও হয়তো রোমান সাম্রাজ্য ফিরে আসার স্বপ্ন দেখতেন ।
তবে তিনি স্বপ্ন সাধারণ নিয়মে দেখতেন, নাকি ইচ্ছামত স্বপ্ন দেখতে ভালোবাসতেন এ নিয়ে বিতর্ক হতে পারে । একবার তিনি তাঁর এক প্রিয় বন্ধুকে চিঠিতে লিখেছিলেন যে তিনি একটা নীল রঙের বই স্বপ্নে দেখেছেন, কিন্তু সেটার নামটা তিনি পড়তে পারেননি। পরবর্তী চিঠিতে তিনি আরও লিখেছেন, তিনি আবার স্বপ্নে ওই বইটা দেখেন এবং এবার তিনি বইটির বিষয়ে অনেক তথ্যও জানান । এই সব কথাই প্রলাপ ভেবে উড়িয়ে দেওয়া যেতে পারে, কিন্তু মনে রাখতে হবে তাঁর ছেলে যখন অসুস্থ ছিলো এবং বহুদিন যাবৎ হার্নিয়ার চিকিৎসা চলছিল, ডিক তাঁর স্বপ্ন অনুযায়ী একটি নির্দিষ্ট জায়গাকে চিহ্নিত করেন এবং পরিষ্কারভাবে ডাক্তারকে নির্দেশ দেন, ওই জায়গায় পরীক্ষা করতে। কাকতালীয়ভাবে ওইখানে শিশুটির হার্নিয়া ধরা পড়ে। এই চিকিৎসায় বেশি বিলম্ব হলে ফলাফল মারাত্মক হতে পারতো। কিন্তু তাঁর অতিপ্রাকৃত দৃষ্টির জন্য সেই যাত্রায় তাঁর সন্তান, সঠিক সময়ে সঠিক স্থানে চিকিৎসা পেয়ে সুস্থ হয়ে ওঠেন। UFO নিয়েও মজা করতে ভালবাসতেন ডিক । তিনি একটি স্থানীয় UFO-বিশ্বাসী গ্রুপে যোগদানও করেছিলেন। আকাশের দিকে অন্ধকার রাতে তাকিয়ে তিনি প্রায়শই অপার্থিব মেধার সন্ধান করতেন।
এই উজ্জ্বল চিন্তাবিদ, লেখকের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে অদ্ভুত কিছু ধারণা ছিল। ডিকের প্রায় চল্লিশেরও বেশি উপন্যাস থেকে তার তার চিন্তায় ভবিষ্যৎ এর চিত্রটা অনেকটাই পরিষ্কার ভাবে বোঝা যায় এবং বিস্ময়ের ব্যাপার হলো, ভবিষ্যৎ সম্পর্কে তাঁর চিন্তা অনেকটাই বাস্তব। তিনি তাঁর সময়ের সমাজ প্রযুক্তি ইত্যাদি জিনিসগুলোর বাস্তব অবস্থা এবং তাঁর সময়ের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার উপর ভিত্তি করে সমাজের প্রায় সমস্ত বিষয় নিয়েই খন্ড খন্ড ভাবে পূর্ণাঙ্গ চিত্র কল্পনা করেছিলেন । আজকের সমাজে ভবিষ্যৎবিদ বা Futurist-রা যা করেন উনি মোটামুটি সেই ধরনের কাজই ৬০-এর দশকে বসে করে গেছেন । তবে এখানে একটা তফাৎ আছে। এখনকার ভবিষ্যৎবিদরা বিজ্ঞানীদের সাথে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত এবং তাঁরা আধুনিক বিজ্ঞান যেসব বিষয়ে উন্নতি করছে এরকম বিষয়গুলি সম্বন্ধে যথেষ্ট ওয়াকিবহাল থাকেন। তাঁদের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনাগুলো মূলত একজন প্রকৌশলীর দৃষ্টিকোণ থেকে লেখা হয়। কিন্তু ফিলিপ কে ডিক একজন প্রযুক্তিবিদের চোখ দিয়ে নয়, একজন কর্মবিজ্ঞান-প্রেমিকের ভাষায় যথেষ্ট চিত্তাকর্ষক ভাবে ভবিষ্যতের ছবি এঁকেছেন।
তাঁর ভবিষ্যত দেখার আশ্চর্য ক্ষমতার উদাহরণ দিতে গেলে সবার প্রথমে যে উপন্যাসটির কথা বলতে হয় সেটা হল The Minority Report. তাঁর এই ছোট গল্পটি নিয়ে স্টিফেন স্পিলবার্গ সিনেমাও বানিয়ে ফেলেছেন । মুখ দেখিয়ে আমরা সবাই ফোন আনলক প্রতিদিনই করছি। কিন্তু ফেসিয়াল রিকগনিশন এর ব্যাপারটা সেই 1956 সালেই ফিলিপবাবু কল্পনা করে ফেলেছিলেন । এই গল্পে উনি পুলিশবাহিনীর বিকল্প হিসেবে মনোবিজ্ঞানীদের প্রয়োগের কথাও ভবিষ্যৎবাণী করেছেন । যদিও সেটা এখনো সম্পূর্ণ রূপে সম্ভব হয়নি । তবে ইতোমধ্যেই বিভিন্ন পরিসংখ্যানগত সফটওয়্যার এবং স্ট্যাটিস্টিকাল মডেলের মাধ্যমে কোন এলাকা বা কোন ব্যক্তির অপরাধ প্রবণতা সম্পর্কে ভবিষ্যৎবাণী করতে পারা যায়। কিছু কিছু ক্ষেত্রে অদূর ভবিষ্যতে তাঁর ভবিষ্যৎবাণী মিলে যাওয়া মনে হয় না কোন কাকতালীয় ব্যাপার হবে। মানুষের মন নিয়ন্ত্রণের জন্য বেশ কিছু শিল্পপতি বর্তমানে যথেষ্ট আগ্রহী, এবং তাঁরা প্রচুর অর্থ ব্যয় করছেন এই গবেষণার পেছনে । তবে রাষ্ট্র-সুরক্ষার নাম এই ধরনের গবেষণার বিষয় লোকচক্ষুর আড়ালেই রাখা হয়।
সম্প্রতি “Fabrican” নামে একটি তাৎক্ষণিক পরিধান তৈরির প্রযুক্তি আবিষ্কৃত হয়েছে। এই স্প্রে, পলিমার এবং প্রাকৃতিক বা সিন্থেটিক ফাইবার থেকে তৈরি করা হয়। এটিকে সংকুচিত করে ক্যানে বন্ধ করে রাখা হয় । উচ্চ চাপ থেকে মুক্ত করে গায়ের উপরে স্প্রে করলে বাতাসের সংস্পর্শে এসে এটা শুকিয়ে যায় এবং একটি ডিসপসিবল জামা তৈরি করে ।এই জিনিসটা অনেকটা কল্পনা করে গেছেন ফিলিপবাবু 1969 সালে তাঁর Galactic Pot-Healer লেখাটিতে।
চালকহীন গাড়ির কথা উনি ১৯৬৬ সালে কল্পনা করে গেছেন। পল ভেরহোভেন যখন Total Recall সিনেমাটি বানিয়েছেন তখন তাঁকেও এই কল্পনাটি আকর্ষিত করে। তাই ডিকের ছোটগল্প We Can Remember It Fore You Wholesale থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে , জনি ক্যাব নামে একটি স্বয়ংক্রিয় ট্যাক্সি পরিষেবা দেখানো হয় , যা যাত্রীদের ভয়েস কমান্ডের উপরে কাজ করে। এই গাড়িগুলি android দ্বারা পরিচালিত এবং যাত্রীর সাথে আলাপচারিতা করতে সক্ষম। এদের চিন্তাশক্তি আছে, মন মেজাজ খুশি থাকলে বাঁশিও বাজাতে পারে । বর্তমানে আমাদের দেশে না হলেও, সাহেবদের দেশে চালকবিহীন গাড়ি একেবারেই দুর্লভ নয়।
একেবারে হাল আমলের চ্যাট জিপিটিও ফিলিপের স্বপ্নে বাস্তব ছিল । ওনার ১৯৬৪ সালে লেখা উপন্যাস "The Penultimate Truth" এ জোসেফ অ্যাডামস চরিত্রটিকে দেখা যায় কীবোর্ড দিয়ে “rhetorizor” যন্ত্রের সাহায্যে বক্তৃতা লেখার চেষ্টা করতে। জোসেফ কিছু শব্দ শুধু লিখছিলেন, আর আশা করছিলেন এই যন্ত্রটি তাকে একটি পূর্ণাঙ্গ বক্তৃতা লিখে দেবে। ফিলিপের এই মেশিনটি ব্যবহারকারী দ্বারা সরবরাহ করা কিছু শব্দ বা রূপকের উপর ভিত্তি করে প্রোপাগান্ডা লিখে দিতে বিশেষভাবে সক্ষম ছিল। বর্তমানে লার্জ ল্যাঙ্গুয়েজ মডেল-এর উপর তৈরি Chat GPT অনেকটা এই ভাবেই কাজ করে, তবে সে প্রোপাগান্ডা ছড়াচ্ছে কিনা সে বিষয়ে এখনই কোন মন্তব্য করা যাচ্ছেনা ।
AI বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে কৌতূহলের শেষ ছিল না ডিকের । ১৯৬৮ সালের বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী উপন্যাস Do Androids Dream of Electric Sheep-এ ডিক এমন এক কল্প জগত তৈরি করেছেন যেখানে মানুষের বিভিন্ন কাজ অ্যান্ড্রয়েড দ্বারা করা হয় ।এই অ্যান্ড্রয়েডগুলোকে মানুষের মতন দেখতে এবং মানুষের পরিবর্তে ব্যবহার করা সম্ভব ছিল। এরা এতটাই বাস্তবিক যে তাদের প্রকৃত মানুষ থেকে আলাদা করা খুবই কঠিন। ডিকের কল্পনার এই অ্যান্ড্রয়েডগুলো শুধুমাত্র মানুষের গতিবিধি নয়, মানুষের আবেগ-অভিব্যক্তিও খুব নিখুঁত ভাবে নকল করতে পারতো। তবে তাঁর কাহিনীতে এই ধরনের এন্ড্রয়েডদের দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক হিসেবে দেখানো হয়েছে। মানুষ প্রায়শই এদের সাথে দুর্ব্যবহার করতো। যদিও রোবট এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার আমাদের সমাজে বিভিন্ন ক্ষেত্রে শুরু হয়ে গেছে এবং আমাদের বিজ্ঞানী এবং প্রকৌশলীরা ইতোমধ্যেই এমন রোবট বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সফটওয়্যার বানিয়ে ফেলতে পেরেছেন যা মানুষের অনেক কঠিন কাজ সহজে করে ফেলতে পারে ,তবুও ডিকের এই কল্পনার জগত থেকে আমরা এখনও বেশ কিছু বছর পিছিয়ে আছি।এই কাহিনীতে উনি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার রোবটের সহানুভূতির প্রসঙ্গে কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন তুলেছেন, যেটা বর্তমানে একটি চূড়ান্ত প্রাসঙ্গিক বিষয় । এআই বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা আর কিছু বছরের মধ্যে মানুষের ক্ষমতাকে ছাড়িয়ে যাবে। কিন্তু মানুষের আবেগ উপলব্ধি সহানুভূতি এই সব বৈশিষ্ট্যগুলো কি তারা বুঝতে পারবে ? প্রায় ৫০ বছর আগে তাঁর মনের এই প্রশ্নগুলোর উত্তর বর্তমানের বিজ্ঞানীরা নিরন্তর খুঁজে চলেছেন ।
প্রযুক্তির ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তা করতে গেলে তাঁর Ubik উপন্যাসটার কথা বলতেই হয়। এই একটা উপন্যাসে ডিক ভবিষ্যতের যে সব স্বপ্ন দেখিয়েছেন , তার মধ্যে কয়েকটির কথা বলছি যেগুলো ইতোমধ্যেই বাস্তব হয়ে গেছে। Ubik-এ উনি এমন একটা ভবিষ্যৎ কল্পনা করেছেন যেখানে পোর্টেবল ফোনে ক্লিক করে সকলের কাছেই উপস্থিত হওয়া যায় এবং একটি বিশ্বব্যাপী নেটওয়ার্কের সাহায্যে এই ফোনগুলো বিশ্বের যে কোন প্রান্তে ব্যবহার করা যেতে পারে। অর্থাৎ বর্তমান যুগের সেলফোন। তাঁর এই উপন্যাসের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ভবিষ্যৎবাণী হলো তাৎক্ষণিক অনুবাদ পরিষেবা। ডিক কল্পনা করেছেন এমন এক যন্ত্ৰ পরিষেবার অস্তিত্ব যা বিভিন্ন ভাষায় কথা বলতে পারে। এর মাধ্যমে ভিন্ন ভাষায় স্বচ্ছন্দ ব্যক্তিরা কোন অসুবিধা ছাড়াই একে অপরের সাথে যোগাযোগ করতে পারবেন । সম্প্রতি গুগল পিক্সেল ফোনে এরকম এক সুবিধার জীবন্ত উদাহরণ দেখা গেছে। ডিক বিশ্বাস করতেন তাঁর এই ইউবিক উপন্যাস প্রকাশের কয়েক বছরের মধ্যেই বাণিজ্যিক মহাকাশ-ভ্রমণ বাস্তবায়িত হবে। সেই সময় বাণিজ্যিক মহাকাশ ভ্রমণ একটি স্বপ্নের চেয়ে খুব বেশি ছিল না, তবে আজ একাধিক কোম্পানি পুনর্ব্যবহার-সক্ষম রকেট এবং অন্যান্য প্রযুক্তির উন্নয়নের মাধ্যমে বাণিজ্যিক মহাকাশ-ভ্রমণ কে বাস্তবায়িত করেছেন । ইতোমধ্যেই হাতে গোণা কয়েকজন ধনপতি অর্থের বিনিময়ে মহাকাশ অভিযান করেও এসেছেন । অদূর ভবিষ্যতে হয়তো এই ব্যবস্থা সর্বজনীন হয়ে উঠবে ।
শুধুমাত্র প্রযুক্তিগত অগ্রগতির বিষয়ে দূরদর্শিতার জন্য নয় , ডিকের কর্মকান্ড চিরন্তন হয়ে থাকবে তাঁর কাহিনীর চরিত্রগুলোর জন্য । অস্তিত্বগত সংকটে এবং বিভিন্ন কারণে সৃষ্ট দ্বিধা-দ্বন্দ্বের সময়ে তাঁর কাহিনীর চরিত্রদের আচরণ, মানুষের চরিত্র সম্পর্কে তাঁর গভীর উপলব্ধির পরিচয় দেয় । প্রযুক্তিগত অগ্রগতির দ্বারা উত্থাপিত নৈতিক চ্যালেঞ্জগুলোকে নিয়ে উনি সময়ের বহু আগেই আলোচনা করে গিয়েছেন, যা কিছুটা বর্তমানে আর অনেকটাই ভবিষ্যতে প্রাসঙ্গিক হবে । দ্রুত প্রযুক্তিগত পরিবর্তনের যুগে ডিকের লেখাগুলো আগামী অনেক যুগ ধরে কম্পাসের কাজ করবে, এই বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই ।
তথ্যসূত্র
Comments
Post a Comment